শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি এবং শিক্ষার্থীদের কোটা বাতিলের আন্দোলন মানতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ এএম

সরকার ঘোষিত সার্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয়কে বৈষম্যমূলক ও অগ্রহণযোগ্য আখ্যায়িত করে এর প্রজ্ঞাপণ বাতিলের দাবিতে রাজপথে নেমেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। গত রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩ তম প্রতিষ্ঠা বাষির্কীর অনুষ্ঠান বর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় মানব বন্ধন এবং অবস্থান গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে দেশের ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের পূর্বঘোষিত আন্দোলন শুরু করায় সেশন জটের চাপে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অতীতে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এমন একাট্টা ভূমিকা অতীতে দেখা যায়নি। দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গণের মর্যাদা ও আস্থার জায়গা বিনষ্ট করে শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমাবনতি ও বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তোলার অভিযোগ করছেন শিক্ষক নেতারা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের নেতারা মূলত শিক্ষামন্ত্রীর বালখিল্যতা, অদূরদর্শিতা ও অযোগ্যতার অভিযোগ তুলেছেন। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা জাতির মেধা, মননশীলতা ও বিবেকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। সেই প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনাকে অবারিত রাখতে মেধাবি শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান, সম্মানি ও মর্যাদার আসনকে অক্ষুন্ন রাখা অপরিহার্য। প্রত্যয় পেনশন স্কিমটি সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে বৈষম্যপূর্ণ এবং এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করার অভিযোগ তোলা হয়েছে।

দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন, একই সময়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আবারো কোটা প্রথা বহালের বিরুদ্ধে রাজপথে জোরালো আন্দোলন শুরু করেছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার বৈষম্যমূলক কোটাপ্রথা সংস্কারের প্রজ্ঞাপণ জারি করে। সম্প্রতি হাইকোর্টের এক আদেশে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপণকে অবৈধ ঘোষণা করে মূলত কোটা প্রথা ফিরিয়ে এনে মেধাবিদের বঞ্চিত রাখার পথ প্রশ্বস্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের কোটায় মেধাহীন, অযোগ্যদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ দিয়ে জাতির মেধাবি সন্তানদের বঞ্চিত করার পাশাপাশি সরকারের সব সেক্টরে অযোগ্য, মেধাহীনদের নিয়োগ দিয়ে দেশকে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দেয়ার এ প্রক্রিয়া কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি-নাতনিদের মধ্যে যারা মেধাবী, তারা সাধারণ চাকরি প্রত্যাশিদের সাথে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই সুযোগ পেতে পারে। অথচ যারা প্রতিযোগিতার যোগ্যতা রাখে না, তারা শুধুমাত্র কোটার কারণে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে কিংবা যাবে। এতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে মেধাবীদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং প্রশাসনে মেধাযুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে, তা আর হয় না। একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে কম মেধাবী যদি প্রতিযোগিতা না করে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, তাহলে ঐ পদটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে মেধাবীদের যুক্ত করা প্রয়োজন, সেখানে দেখা যাচ্ছে, কোটা পদ্ধতির কারণে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে উন্নয়ন শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই দেশে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী বেকার হয়ে আছে। কোথাও তাদের চাকরির সুযোগ হচ্ছে না। একদিকে কোটা পদ্ধতি, অন্যদিকে মন্ত্রী-এমপি এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজনের চাকরির তদবিরের কারণে মেধাবী বেকাররা বঞ্চিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য মূলত অযোগ্য, মেধাহীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও সরকারি কর্মকর্তারাই দায়ী। এদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো কোটার আওতায় নিয়োগ পেয়েছিলেন। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করা মেধাবী শিক্ষার্থীকেই একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি। এমনকি উপমহাদেশে প্রতিবেশি দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও বাংলাদেশের শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি বেতন ও সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। কোটা প্রথার কারণে প্রকৃত মেধাবিরা সরকারি চাকরিতে যথাযথ আসন না পাওয়ায় তারা হতাশ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এভাবে সরকার মূলত মেধা পাচারকেই উৎসাহিত করছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থা বাতিল করে সার্বজনীন পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার বিরুদ্ধে শিক্ষকরা শুরু থেকেই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এ বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপণ জারি হওয়ার পর থেকেই তা বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সীমিত পরিসরে কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিল। কিন্তু দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অভিন্ন অবস্থান সত্ত্বেও সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বা দায়িত্বশীল কেউই আগে থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে এগিয়ে আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে কর্মবিরতি পালন করছে, তা যৌক্তিক এবং সমর্থনযোগ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানহীনতা, শিক্ষকদের দলবাজির মূলেও রয়েছে কোটাসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বজনপ্রীতি। পেনশন স্কিমে শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য এবং কোটা পুনর্বহালের মতো অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবিকে আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করতে হবে। তাদের রাজপথে ঠেলে দিয়ে কিংবা বলপ্রয়োগ করে প্রতিরোধের মতো কোনো পদক্ষেপ সুফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে, শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে আরো বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা কাম্য। বিতর্কিত পেনশন স্কিম ও কোটাবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতা অগ্রাহ্য করে শিক্ষাঙ্গণে অস্থিতিশীলতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

৩৬ বছর পর জার্মান বধ,সেমিতে স্পেন

৩৬ বছর পর জার্মান বধ,সেমিতে স্পেন

খেলতে খেলতেই মারা গেলেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া

খেলতে খেলতেই মারা গেলেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া

স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পর তার সাথে যৌন সম্পর্ক করা প্রসঙ্গে।

স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পর তার সাথে যৌন সম্পর্ক করা প্রসঙ্গে।

লোক নাট্যদলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী

লোক নাট্যদলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী

১৩ বছর পর অভিনয়ে ফিরছেন মেহের আফরোজ শাওন

১৩ বছর পর অভিনয়ে ফিরছেন মেহের আফরোজ শাওন

মাধ্যমিক পর্যায়ে কোডিং শিক্ষা প্রসঙ্গে

মাধ্যমিক পর্যায়ে কোডিং শিক্ষা প্রসঙ্গে

প্রাকৃতিক রক্ষাব্যুহ সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

প্রাকৃতিক রক্ষাব্যুহ সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

অসত্য তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে বের হয়ে আসতে হবে

অসত্য তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে বের হয়ে আসতে হবে

চাঁদাদাবি করায় আখাউড়ায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

চাঁদাদাবি করায় আখাউড়ায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

পশ্চিম তীরে পাঁচ সহস্রাধিক নতুন আবাসন অনুমোদন নেতানিয়াহুর

পশ্চিম তীরে পাঁচ সহস্রাধিক নতুন আবাসন অনুমোদন নেতানিয়াহুর

হীরার গয়নায় শাস্তির মুখে বলসোনারো

হীরার গয়নায় শাস্তির মুখে বলসোনারো

ইসরাইলকে থামাতে হবে, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে : এরদোগান

ইসরাইলকে থামাতে হবে, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে : এরদোগান

মানুষের কামড়ে সাপের মৃত্যু

মানুষের কামড়ে সাপের মৃত্যু

রকেট হামলায় ইসরাইলি কোম্পানি কমান্ডার নিহত

রকেট হামলায় ইসরাইলি কোম্পানি কমান্ডার নিহত

ভোট দিয়ে যে আহ্বান জানালেন খামেনি

ভোট দিয়ে যে আহ্বান জানালেন খামেনি

যুক্তরাষ্ট্র বাহিনীকে জাপানের হুঁশিয়ারি

যুক্তরাষ্ট্র বাহিনীকে জাপানের হুঁশিয়ারি

গাজা-ইসরাইল যুদ্ধে পশ্চিমের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি

গাজা-ইসরাইল যুদ্ধে পশ্চিমের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি

এসসিও’র শীর্ষ সম্মেলনে মোদি কেন গেলেন না

এসসিও’র শীর্ষ সম্মেলনে মোদি কেন গেলেন না

জিম্মি প্রশ্নে মধ্যস্থতাকারী দল পাঠাবে ইসরাইল

জিম্মি প্রশ্নে মধ্যস্থতাকারী দল পাঠাবে ইসরাইল

আটলান্টিক থেকে ৮৯ লাশ উদ্ধার

আটলান্টিক থেকে ৮৯ লাশ উদ্ধার